Cross-Column

Saturday, July 15, 2017

VEDAS

পৃথিবীর আদি সাহিত্য-বেদ ও তার বিভাগ 
আজ অবধি যত বই লেখা হয়েছে তার মধ্যে বিশ্বজনীন সাহিত্য বা বিশ্ব সাহিত্যের সংখ্যা খুব বেশি নয়। সকলের আগে যে বইখানি এই সাহিত্যের মধ্যে ধরা হয় সেটি হলো বেদ। এটিকে সবার আদি সাহিত্যও বলা যেতে পারে। অবশ্য বেদ যখন রচিত হয় তখনও লিখিত সাহিত্যের সৃষ্টি হয় নি। বেদ ও মুখে মুখে রচিত হয়েছিল এবং শুনে শুনে ঋষিরা  তা মুখস্ত করে নিয়ে শিষ্য পরম্পরায় প্রচার করে গিয়েছিলেন।সেজন্য এর আরেক নাম ''শ্রুতি''।
বেদ এর সৃষ্টি কিভাবে হয়েছিল সে সম্পর্কে পুরান এ একটি গল্প আছে। একদিন আদি পুরুষ ব্রম্ভা যোগাসনে বসে আত্মচিন্তায় মগ্ন হয়ে আছেন,এমন সময় তাঁর হৃদয় এ অস্ফুট নাদধ্বনি হলো। পরে তা থেকে প্রণব এবং সেই প্রণব থেকে বেরিয়ে এলো স্বর ও ব্যাঞ্জন বর্ণরাশি। ব্রম্ভা সেই বর্ণগুলো একত্রিত করে কতকগুলো শব্দ উচ্চারণ করলেন। তাই হলো বেদ। অর্থাৎ বেদ কোনো মানুষের রচনা নয় -স্বয়ং ব্রম্ভার মুখ থেকে বেরিয়ে এসেছে। তাই বেদকে  বলা হয় অপৌরুষেয়।
পুরানে অনেক ঘটনাকেই এই ভাবে কোনো -না -কোনো দেবতার সাথে জড়িয়ে অলৌকিক ভাবে দেখানো হয়েছে,হয়তো লোকের শ্রদ্ধা বাড়াবার জন্যই। তবে ঐতিহাসিকদের মতে আর্য ঋষিরা যখন প্রথম ভারতে এসে সিন্ধু নদের ধারে বসতি স্থাপন করলেন তখন ওখানকার সৌন্দয দেখে তাঁরা মুগ্ধ হন এবং প্রকৃতির এক একটি রূপকে দেবতা বলে ধরে নিয়ে যাগযজ্ঞের সাহায্যে তাঁদের আরাধনা করতে শুরু করেন। এই সময় তাঁরা সৃষ্টিকর্তার অলৌকিক শক্তি উপলব্ধি করতে থাকেন আর সাথে সাথে তাঁদের সামনে খুলে যায় সত্যের নানান রূপ। যাঁদের সামনে সৃষ্টিকর্তার সেই অসাধারণ শক্তি আর সত্যের প্রকৃত রূপ উদ্ঘাটিত হয়েছিল তাঁদের বলা হতো ঋষি এবং যে সাহিত্যের ভিতর দিয়ে তাঁরা তাদের মনের ভাব প্রকাশ করেছিলেন তারই নাম বেদ। 
বেদ কথাটি এসেছে 'বিদ' ধাতু থেকে।'বিদ' ধাতুর মানে জানা অর্থাৎ যে সাহিত্যে জ্ঞানের নানা বিষয় নিয়ে বর্ণনা করা হয়েছে তাই হলো বেদ।
প্রাচীন পন্ডিতেরা অবশ্য 'বেদ' শব্দটির অর্থ নিয়ে অনেক মাথা ঘামিয়েছেন এবং নানান ভাবে এর ব্যাখ্যা করেছেন। কেউ বলেছেন যা দিয়ে ধর্ম জানা যায় বা লাভ করা যায় তাই হলো বেদ। কেউ বলেছেন, যা থেকে কিসে আমাদের ইষ্টলাভ হবে,কি করলে আমরা অনিষ্ট এড়িয়ে যেতে পারবো -এই সব এর উপায় আমরা জানতে পারি তাই হলো বেদ। কেউ বলেছেন প্রত্যক্ষ ভাবে বা অনুমান করেও যা জানা যায় না -বেদের সাহায্যে তা আমরা জানতে পারি। তাই এর এইরূপ নামকরণ। এরকম আরো নানা রকম অর্থ করেছেন নানা জনে। এদের মধ্যে সায়নাচার্যের টীকা বা ভাষ্য হচ্ছে সব চেয়ে নামকরা। 
যাই হোক এসব থেকে এতটুকু বুঝতে অসুবিধা হয় না যে পরম সত্য কি সে সম্পর্কে ঋষিদের চিন্তার ফলে যে সাহিত্য রচিত হয়েছিল তাই হলো বেদ।
বেদের কোনো কোনো অংশ ছন্দোবদ্ধ স্তব বা স্তোত্র দিয়ে রচিত হয়েছিল ,আবার কোনো কোনো অংশ রচিত হয়েছিল গান দিয়ে। তাছাড়া গদ্যে রচিত মন্ত্র দিয়েও এর কিছু কিছু  অংশ রচিত হয়। মহর্ষি ব্যাস যজ্ঞের ব্যবহার করবার জন্য এই বিভিন্ন ধরণের মন্ত্র সংকলন করে ৪ টি পৃথক ভাবে বেদকে ভাগ করেন। বেদের যে সব অংশ বা মন্ত্র স্তোত্র বা  ছন্দোবদ্ধ ভাবে রচিত হয়েছিল সেগুলি একত্র করে তৈরি হলো ঋকবেদ। যজ্ঞের সময় যজ্ঞের হোতা ও তাঁর সঙ্গীরা এই ঋকবেদ মন্ত্র বা স্তোত্র আবৃত্তি করে দেবতাদের স্তব করতেন এবং তাদের যজ্ঞে আহ্বান করতেন। বেদের যে অংশ গান দিয়ে রচিত হয়েছিল সেগুলি একত্র করে তৈরি হলো সামবেদ।ঋষিরা -বিশেষ করে ধর্মের উদ্গাতা এবং তাঁর সঙ্গীরা যজ্ঞের সময় এই মন্ত্রগুলি গান করতেন। অমনি ধারা গদ্যময় মন্ত্রগুলি একত্র করে তৈরি হলো যজুবেদ।যজ্ঞে আহুতি দেবার সময় অধ্বযু ও তাঁর সহকর্মীরা এই  যজুমন্ত্র ব্যবহার করতেন। এছাড়া আর যে সব মন্ত্র সেগুলি সংকলন করে তৈরি হলো ,সেগুলি হলো অথর্ব বেদ। তা হলে বেদ হলো ৪ প্রকার।মহর্ষি ব্যাস বেদকে এইভাবে ভাগ করেছিলেন বলে তাঁকে বলা হয় বেদব্যাস। 
বেদব্যাসের ৪ শিষ্য।পৈল,বৈশম্পায়ন ,জৈমিনি আর সুমন্ত্র।গুরু এই চার শিষ্যের প্রথম জনকে ঋকবেদ ,দ্বিতীয় জনকে যজুবেদ,তৃতীয় জনকে সামবেদ এবং চতুর্থ জনকে অথববেদ এর শিক্ষা দিলেন।বৈশম্পায়ন এর এক শিষ্য ছিলেন যাজ্ঞবল্ক্য। তিনি গুরুর কাছে   যজুবেদ শিক্ষা করে নিজের উপর অত্যধিক আত্মবিশ্বাসের ফলে সে বিদ্যা ত্যাগ করেন। বলাবাহুল্য গুরুও তাকে পরিত্যাগ করেন। পরে যাজ্ঞবল্ক্য নিজের ভুল বুঝতে পেরেই সূযের উপাসনা করে তাকে তুষ্ট করে আবার সেই বেদবিদ্যা আয়ত্ত করেছিলেন। এই ঘটনাকে কেন্দ্র করেই নাকি যাজ্ঞবল্ক্য এর পরিত্যাক্ত যজুবেদকে কৃষ্ণ যজুবেদ এবং নতুন করে শেখা যজুবেদকে শুক্ল যজুবেদ বলা হয়ে থাকে। 
আমরা ৪ টি বেদ এর কথা বলেছি বা পড়েছি। কিন্তু শাস্ত্রে অনেক জায়গায় বেদকে ত্রয়ী বলা হয়েছে অর্থাৎ বেদ তিনটি-ঋক,সাম আর যজুঃ।এ থেকে কারও কারও ভুল ধারণা আছে যে অথববেদ সত্যিকার বেদ নয়। অথর্ববেদে যে সব মন্ত্র আছে তা যজ্ঞে ব্যবহার করা হতো না বলেই ওকে ত্রয়ীর সাথে যোগ করা হয় নি।
প্রতিটি বেদে আবার ২ টো করে বিভাগ আছে -"মন্ত্র'' আর ''ব্রাহ্মন''।মন্ত্রকে আবার ''সংহিতা'' ও বলা হয়,কারণ মন্ত্রগুলো সমহিত বা একত্র করে সাজানো হয়েছিল। এই সমহিত কথাটি থেকেই সংহিতা কথাটি এসেছে।ব্রাহ্মন বলতে কিন্তু ব্রাহ্মন,ক্ষত্রিয়,বৈশ্য,শূদ্র এই ৪ বর্ণের যে ব্রাহ্মন তা মনে কর না। এ ব্রাহ্মন আলাদা। আসলে বেদের যে অংশে তার অপ্রকাশিত অর্থ ভালো করে বোঝানো হয়েছে,সংহিতার প্রয়োগ দেখানো হয়েছে-তারই নাম দেওয়া হয়েছে ব্রাহ্মন।ব্রহ্ম (ন) শব্দের মানেও বেদ,এবং তার সাথে ঘনিষ্ট সম্পর্ক থাকার দরুনই একে বলা হয় ব্রাহ্মন।কি আছে ব্রাহ্মণে ?কি করা উচিৎ,কি করা অনুচিত এই সব বিধিনিষেধ ,যাগযজ্ঞ কি ভাবে করতে হবে,ব্রহ্মবিদ্যা বলতে কি বোঝায়-এই রকম অনেক কথা। 
সে যুগে মানুষ ৫০ বছর বয়স হয়ে গেলেই সংসার ছেড়ে দিয়ে বনে গিয়ে বাস করতো।তাকে বলা হতো বানপ্রস্থ। বেদের কোনো কোনো অংশ এমনভাবে রচিত হয়েছে যে সেগুলি বিশেষ করে এই বনে অর্থাৎ অরণ্যে বসে চর্চা করবার উপযোগী। তাই এই অংশগুলোকে বলা হয় আরণ্যক। বনে গিয়ে তো আর লোকে যাগযজ্ঞের দিকে বেশি নজর দিতে পারে না -তখন মন চাই আরো উচ্চতর এবং দুরূহ তত্ত্বের কথা জানতে,আপন মনে ধ্যান বা উপাসনা করতে।আরণ্যক তাই অনেকটা সেভাবে রচিত। 
এ ছাড়া আরো একভাবে বেদকে ভাগ করা যেতে পারে -মোটামুটি ২ ভাগে। কর্মকান্ড আর জ্ঞানকাণ্ড। অবশ্য এ দুই নাম এ আলাদা কোনো বই নেই। সমস্ত বেদেই এই দুই অংশ অর্থাৎ কর্ম আর জ্ঞান এর আলোচনা দেখতে পাওয়া যায়। কর্মকান্ডে যাগযজ্ঞের বিধি এবং নানা রকম লৌকিক ক্রিয়াকলাপের কথাই বিশেষ করে আলোচনা করা হয়েছে।আর জ্ঞানকাণ্ডে আছে আরোও উচ্চাঙ্গের আধ্যাত্বিক সব আলোচনা। 
বেদের আর একটি বিষয়কে বলা হয় সূত্র। এক কথায় একে বলা যেতে পারে জ্ঞানলাভের বিধি। এই সূত্র কে আবার ৬ ভাগে ভাগ করা হয়েছে-শিক্ষা ,ছন্দ,ব্যাকরণ,নিরুক্ত,জ্যোতিষ আর কল্প। শিক্ষা হলো স্তোত্র গুলি বিশুদ্ধ ভাবে উচ্চারণ করার রীতি ,ছন্দ হলো স্তোত্র রচনার ভঙ্গী,ব্যাকরণ হলো শুদ্ধ ভাবে প্রকাশ পদ্ধতি ,নিরুক্ত হলো শব্দের অর্থব্যাখ্যা,জ্যোতিষ হলো ভবিষ্যৎ সম্ভাবনার আলোচনা আর কল্প হলো যাগযজ্ঞের বিধান।
বেদের খানিকটা মোটামুটি পরিচয় শুধু এখানে দেওয়া হলো ,কিন্তু ভেতরের সব কথা বুঝিয়ে বলা এখানে সম্ভব নয়। শুধু এটুকু বলা যেতে পারে যে যেসব গূঢ় তথ্য অপূর্ব ভাষায় ও ভঙ্গীতে প্রকাশ করা হয়েছে তার কথা ভাবলে এই এতদিন পরেও বিস্ময়ে হতবাক হয়ে যেতে হয়। অথচ সেই কোন অতীত যুগে আর্য ঋষিরা এই সত্য উপলব্ধি করে গেছেন!এই কারণে আজও তাঁদের বলা হয় সত্যদ্রষ্টা।

No comments:

Post a Comment