ডিনামাইট আবিষ্কার কিভাবে হলো ?
যে সুইডিস রসায়নবিদ ,প্রযুক্তিবিদ ও শিল্পপতি ডিনামাইট ও তার চেয়ে ও শক্তিশালী বিস্ফোরক পদার্থ আবিষ্কার করেছিলেন তার নাম নোবেল অর্থাৎ আলফ্রেড বানার্ড নোবেল। যার নামে নোবেল পুরস্কার দেওয়া হয়।
আলফ্রেড এর বাবা ইমানুয়েল পেশায় ছিলেন একজন ইঞ্জিনিয়ার,উদ্ভাবক ও শিল্পপতি।শৈশবে আলফ্রেড তার বাবার কাছে ইঞ্জিনিয়ারিং বিদ্যার মূল নীতি গুলি আয়ত্ত করেছিলেন।
১৮৩৭ সালে ইমানুয়েল নোবেল ব্যবসায় আর্থিক লোকসানের জন্য চলে যান রাশিয়ার সেন্ট পিটার্সবার্গএ। সেখানে গিয়ে তিনি খনিতে ব্যবহৃত হয় এমন কিছু বিস্ফোরক পদার্থ তৈরির কারখানা স্থাপন করেন।স্থাপন করেন যন্ত্রপাতি ও কলকব্জা তৈরির একটি কারখানাও।
দেখতে দেখতে ৮ টি বছর কেটে যায়। ১৮৫০ সালে আলফ্রেড নোবেল রাশিয়া ছেড়ে প্যারিসে চলে যান রসায়নবিদ্যা অধ্যায়ন করতে। পড়া শেষ করে তিনি আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রে গিয়ে জন এরিকসনের তত্ত্বাবধানে চার বছর ধরে লোহার তৈরি কামানবাহী যুদ্ধজাহাজ বানানোর কলাকৌশল আয়ত্ত করেন। তারপর সেন্ট পিটার্সবার্গে ফিরে এসে পিতার কারখানায় যোগ দেন। ওই কারখানায় তখন ক্রিমিয়ার যুদ্ধ এর ব্যবহারের উপযোগী নানারকম অস্ত্রশস্ত্র তৈরি হতো। ১৮৫৬ সালে যুদ্ধ শেষ হলে পর কারখানাটি শান্তির সময়ে ব্যবহারের উপযোগী স্টিম চালিত জলযানের বিবিধ যন্ত্রপাতি নির্মাণে অসমর্থ হয়ে পড়ে। ১৮৫৯ সালে কোম্পানিটি দেউলিয়া হয়ে যায়।
আলফ্রেড ও তাঁর পিতামাতা সুইডেন এ ফিরে আসেন। আলফ্রেডের দুই ভাই রবার্ট ও লুডভিগ থেকে যান রাশিয়াতে। উদ্দেশ্য -সেখানে তাঁদের পিতার ফেলে আসা ব্যাবসার অংশবিশেষ উদ্ধার করা। এদিকে আলফ্রেড তাঁর বাবার তালুকে গড়ে তোলেন বিস্ফোরক দ্ৰব্য প্রস্তুতির একটি ছোট পরীক্ষাগার। ওই সময় একমাত্র বিস্ফোরক দ্ৰব্য ছিল বারুদের মতো দেখতে একরকম কালো রঙের পাউডার। খনিতে বিস্ফোরণ ঘটানোর জন্যে ওই কালো রঙের বিস্ফোরক পদার্থটিই ব্যবহার হতো। তারপর আবিষ্কৃত হলো নতুন ধরণের এক তরল বিস্ফোরক। নাম তাঁর ''নাইট্রো গ্লিসারিন''।এটি আগে ব্যবহৃত বিস্ফোরক দ্রব্যের চেয়ে বহুগুন শক্তিশালী হলে কি হবে ,উদ্বায়ী পদার্থ বলে একে নাড়াচাড়া করার অসুবিধা ছিল অনেক। খুব সাবধানে নাড়াচাড়া করতে না পারলে এটির বিস্ফোরণ ঘটে যেত।
যাইহোক,১৮৬২ সালে আলফ্রেড বার্নার্ড নোবেল এই নাইট্রোগ্লিসারিন উৎপাদনের একটি কারখানা খুলে ফেললেন। সেই সঙ্গে গবেষণাও চালাতে লাগলেন -কিভাবে এই তরল বিস্ফোরক পদার্থটিকে নাড়াচড়া করা যায় ,তাই নিয়ে। ১৮৬৩ সালে নোবেল এমন একটি যান্ত্রিক ও ব্যাবহারিক উপায় উদ্ভাবন করে ফেললেন,যার সাহায্যে একটুখানি স্ফুলিঙ্গ উৎপাদন করে একটি ধাতব পাত্রে রাখা অনেকটা নাইট্রোগ্লিসারিনকে নিরাপদে বিস্ফোরিত করা যায়। এই সময় থেকে আলফ্রেডের ভাগ্যোদয়ের সূচনা হয়। এর মাত্র দু বছর পরে ১৮৬৫ সালে নোবেল ''ব্লাস্টিংক্যাপ'' নামে এক উন্নতমানের বিস্ফোরণ ঘটানোর যন্ত্র আবিষ্কার করে ফেললেন। যন্ত্রটির ধাতব টুপিতে মার্কারি ফুলমিনেট নামক একটি রাসায়নিক যৌগ ভরা থাকতো। শুষ্ক অবস্থায় এই যৌগ টিতে তাপ,আঘাত অথবা ঘর্ষন লাগলেই বিস্ফোরণ ঘটে যায়। - এই ব্লাস্টিংক্যাপ আবিস্কারই আধুনিক উচ্চশক্তি সম্পন্ন বিস্ফোরক দ্ৰব্যকে বিস্ফোরিত করার সূচনা ঘটায়।
নাইট্রোগ্লিসারিন যৌগটি এতই শক্তিশালী বিস্ফোরক পদার্থ যে ,একে নাড়াচাড়া করা বা এক জায়গা থেকে অন্যত্র চালান দেওয়া খুবই বিপদজনক ব্যাপার।১৮৬৪ সালে নোবেলের নাইট্রোগ্লিসারিন কারখানায় এক প্রচন্ড বিস্ফোরণ ঘটে কারখানাটি প্রায় ধ্বংস হয়ে যায়। আর সেই দুর্ঘটনায় নোবেলের ছোটভাই এমিল ও আরো কিছু কর্মী প্রাণ হারান। এতেও হতাশ না হয়ে আলফ্রেড আরো কয়েকটি নাইট্রোগ্লিসারিন কারখানা গড়ে তুললেন। নিরাপত্তার জন্য ব্যবহার করতে লাগলেন ''ব্লাস্টিং ক্যাপ''।এতে দুর্ঘটনা কমলেও সম্পূর্ণ নির্মূল হলো না।
এরপর আলফ্রেড আবিষ্কার করলেন ডিনামাইট।এটি তার একটি গুরুত্বপূর্ণ আবিষ্কার। ১৮৬৭ সালে তিনি এটি আবিষ্কার করেন। আবিষ্কারটি ঘটে এইভাবে : একদিন পরীক্ষাগারে নোবেলের এক সহকর্মী নাইট্রোগ্লিসারিন ভরা কয়েকটি পাত্র বিদেশে পাঠাবার জন্য প্যাক করছিলেন। হঠাৎ তাঁর হাত ফস্কে একটি পাত্র মাটিতে পড়ে যায়। মেঝেতে ছড়ানো ছিল এক বিশেষ ধরণের মাটি ,যা প্যাকিং এর কাজে লাগতো। নাইট্রোগ্লিসারিন ভরা এই পাত্রটি পড়লো গিয়ে সেই মাটির ওপর। তাই না দেখে পরীক্ষাগারের কর্মীরা তো ভয়ে অস্থির। এই বুঝি বা বিস্ফোরণ ঘটে। আলফ্রেড নোবেলও একটু দূরে দাঁড়িয়ে এ সব ঘটনা দেখছিলেন।কিন্তু কি আশ্চর্য ব্যাপার বিস্ফোরণ আদৌ ঘটলো না। আলফ্রেড তখন এই মাটি সমেত নাইট্রোগ্লিসারিন সাবধানে তুলে এনে পরীক্ষা করে দেখলেন যে ,নাইট্রোগ্লিসারিন এর বিস্ফোরণ ক্ষমতা এতটুকুও কমেনি,কিন্তু মাটির সাথে মিশে জমাট বেধে কঠিন হয়ে গিয়ে নাড়াচাড়া করার পক্ষে জিনিসটা বেশ নিরাপদ হয়েছে।
আকস্মিক ঘটে যাওয়া এই ঘটনাটি আলফ্রেড নোবেল এর ইচ্ছাকে অপ্রত্যাশিতভাবে পূর্ণ করে দিলো। তিনি আরো পরীক্ষা করে দেখলেন যে কাইজেলগার নামক সিলিকাযুক্ত একরকম সচ্ছিদ্র মাটি নাইট্রোগ্লিসারিনকে অবশোষণ করে। তার ফলে নাইট্রোগ্লিসারিন ও কাইজেলগার মিশ্রণকে নিরাপদে নাড়াচাড়া করা যায়। নতুন এই মিশ্র পদার্থকে নোবেল নাম দিলেন ''ডিনামাইট''।
১৮৬৭ সালে নোবেল ব্রিটেনএ এবং পরের বছর আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রে এই পদার্থটি আবিষ্কারের পেটেন্ট নিলেন। ডিনামাইট আবিষ্কারের পর সারা বিশ্বে নোবেলের খ্যাতি ছড়িয়ে পড়লো এবং পাথর ফাটিয়ে সুড়ঙ্গ কাটতে ,খাল কাটতে ,কয়লার খনিতে কয়লার চাঙড় ফাটাতে ও রেলপথ নির্মাণের কাজে ডিনামাইট ব্যবহার হতে লাগলো।
No comments:
Post a Comment