Cross-Column

Saturday, July 8, 2017

TROY

                     হোমারের লেখা ইলিয়াড ও ওডিসি এর গল্প (সংক্ষেপিত)

আমাদের সংঙ্কৃত সাহিত্যে যেমন রামায়ণ আর মহাভারত,তেমনি গ্রিক ভাষায় ও অনুরূপ দুখানি মহাকাব্য হচ্ছে "ইলিয়াড" আর "ওডিসি"।ইউরোপের সবচেয়ে পুরোনো সভ্য দেশগুলি র একটি হচ্ছে গ্রিস। সেখানে থিবস নাম এ এক নগর ছিল। এই নগরের তোরণে একজন অন্ধ চারন কবি গান গেয়ে ভিক্ষা করতেন। রাজরাজাদের কাহিনী নিয়ে তিনি গান বাঁধতেন। কাহিনীগুলি এমনই চিত্তাকর্ষক যে হাজার হাজার বছর পরেও লোকে তা ভোলে নি। ভোলে নি সেই অন্ধ চারন কবির নামটিও।ইনি হচ্ছেন  ইলিয়াড ও ওডিসি এর রচয়িতা মহাকবি হোমার।
এই ইলিয়াড আর ওডিসি আমাদের রামায়ণ-মহাভারতের মতোই দুখানি মহাকাব্য আর আমাদের দেশের রামায়ণ-মহাভারতের মতোই বই দুখানি ওদেশে আদর পেয়ে আসছে। শুধু আদরই পায় নি,যুগে যুগে কত কবি ,কত সাহিত্যিক কে প্রেরণা যুগিয়েছে। হাজার হাজার বছর ধরে লোকে সেই বিস্ময়কর কাহিনী শুনতে শুনতে কৌতূহলে,বিস্ময়ে মুগ্ধ হয়েছে।হর্ষে   বিষাদে ভরে গেছে তাদের মন। পৃথিবীর কত ভাষায় যে বই দুটি অনূদিত হয়েছে তার ঠিক নেই। রামায়ণ-মহাভারতের মতোই বিশ্ব সাহিত্যের ইতিহাস এ এই দুটি বই এর সমকক্ষ বই খুব কমই আছে।
                                                        "ইলিয়াড" এর কাহিনী
গ্রিস দের দেবতা স্বর্গে র রাজা জিউস।একদিন এক ভোজসভায় সমস্ত দেবদেবী কে তিনি নিমন্ত্রণ করলেন। কিন্তু বাদ পড়লেন একজন। তিনি হচ্ছেন অশান্তি এর দেবী। অশান্তি দেবী ক্ষুন্ন হলেন। আড়াল থেকে দেবতাদের সভায় তিনি একটি সোনার আপেল ফেলে দিলেন,আর আপেলের গায়ে লিখে দিলেন," সবার চেয়ে যে সুন্দরী এ আপেল টি তার জন্য"।
এখন দেবী দের মধ্যে তিনজন ছিলেন পরমা সুন্দরী -হীরা,এথিনা আর আফরোডাইট।তিন জনেই দাবি করলেন আপেলটি।শেষে যখন নিজেদের মধ্যে মীমাংসা হলো না তখন তারা নেমে এলেন পৃথিবীতে। ট্রয় এর রাজপুত্র প্যারিস -পরম সুন্দর পুরুষ বলে তাঁর অসম্ভব খ্যাতি।পাহাড়ের উপর বসে তিনি পিতার মেষ পাহারা দিচ্ছিলেন।তিনি দেবী এসে বিচারের ভার দিলেন তাঁরই ওপরে।
কিন্তু সেই সঙ্গে তিনজনই নানারকম লোভ দেখাতেও ছাড়লেন না। হীরা দেবরাজ জিউসের পত্নী ,তিনি লোভ দেখালেন ক্ষমতার। এথেনা লোভ দেখালেন জ্ঞান ও বিদ্যার। আর আফ্রোডাইট?তিনি দেখালেন ভালোবাসার। বল্লেন "ক্ষমতা আর বিদ্যা দিয়ে কি হবে প্যারিস,আমাকে যদি তুমি সবসেরা মেনে নিয়ে আপেল টি দাও তা হলে আমি পৃথিবীর সবচেয়ে সেরা সুন্দরী মেয়ের সাথে তোমার বিয়ে দেব।
প্যারিস আর চিন্তা না করে আফ্রোডাইট কে দিয়ে দিলেন আপেলটা। ফলে একজন যেমন খুশি হলেন আর দুজন গেলেন ভীষণ চটে। তারা ঠিক করলেন প্যারিসকে এর শাস্তি দিতে হবে।
গ্রিস দেশের স্পাটা রাজ্য,তারই রাজা মেনেলাস। তার পত্নী হেলেন ছিলেন তখন পৃথিবীর সব-সেরা সুন্দরী।আফ্রোডাইট এর চক্রান্তে প্যারিস স্পাটা রাজ্যের অতিথি হলেন। তারপর একদিন সুযোগ বুঝে হেলেনকে নিয়ে পালিয়ে এলেন নিজের দেশ ট্রয় এ।
গ্রিকরা এ অপমান সহ্য করতে রাজি হলো না। মেনেলাস এর দাদা এগামেমনন ছিলেন গ্রিসের সম্রাট। তিনি গ্রিসের সমস্ত রাজাদের একত্রিত করলেন। সদলবলে ট্রয় আক্রমণ করলো গ্রিকরা। অবরোধ করে রাখলো প্রাচীর ঘেরা শহর।
শুরু হলো যুদ্ধ। বিখ্যাত ট্রয়ের যুদ্ধ। এই নিয়ে লেখা হোমারের ইলিয়ার্ড কাব্য।ট্রয়ের আর একনাম ইলিয়াম।তাই থেকে বইয়ের ওই নাম। অধিবাসীদের বলা হতো ট্রোজান। ১০ বছর ধরে যুদ্ধ চললো। হাজার হাজার গ্রিক বীর ও ট্রোজান বীর নিহত হলেন। তাঁদের মধ্যে ট্রোজানদের বীর সেনাপতি হেক্টর এবং গ্রিকদের শ্রেষ্ঠ বীর আকিলিস ও ছিলেন।কিন্তু জয় পরাজয়ের নিস্পত্তি হলো না। তারপর হঠাৎ একদিন গ্রিকরা লড়াই ছেড়ে দিয়ে দেশে ফেরার জন্য জাহাজে গিয়ে উঠলো।নগরের বাইরে যুদ্ধের মাঠে পরে রইলো একটা প্রকান্ড কাঠের ঘোড়া।
ট্রোজানরা ভাবলো গ্রিকরা বুঝি ঘোড়াটা ফেলে পালিয়েছে। বিজয়ের চিহ্ন হিসাবে মহাসমারোহে তারা সেটা টেনে নিয়ে এলো শহরের মধ্যে।
আসলে সেটাই ছিল গ্রিকদের একটা কৌশল। ওই বিরাট কাঠের ঘোড়াটি এমনভাবে তৈরি করা হয়েছিল যে তার পেটটা ছিল ফাপাঁ আর তার মধ্যে লুকিয়ে ছিল বাছাই-করা যত গ্রিক সৈন্য।রাত দুপুরে যখন সমস্ত ট্রোজানরা উৎসব কোলাহলে মত্ত ,তখন ওই গ্রিক সৈন্য রা ঘোড়ার ভিতর থেকে বেরিয়ে এসে নগরের ফটক খুলে দিলো ,অন্য গ্রিক  সৈন্য রা সত্যি সত্যি জাহাজ চড়ে পালায় নি ,তারা কাছে পিঠে লুকিয়ে ছিল। ফটক খুলতে তারা দলে দলে নগরের মধ্যে ঢুকে পড়লো।
তারপর? তারপর আর কি ,শুরু হলো হত্যাকান্ড ,লুটপাট। আগুন জ্বালিয়ে সমস্ত শহর পুড়িয়ে ধ্বংস করে দিলো তারা।
এইভাবে শেষ হলো ১০ বছরের ট্রয় যুদ্ধ। হেলেনকে উদ্ধার করে গ্রিকরা ফিরে এলো নিজেদের দেশে।
                                                                       "ওডিসির গল্প"
হোমারের অপর মহাকাব্য হচ্ছে ওডিসি -ট্রয় যুদ্ধের অন্যতম গ্রিক নায়ক ওডিসি বা ওডিসিউস কে নিয়ে লেখা। ঠিক ইলিয়ার্ড এর পরবর্তী ঘটনা নিয়ে রচিত এই মহাকাব্য।
ট্রয় যুদ্ধের পর ফেরার পথে একখানা জাহাজ ঝড়ের মুখে দল থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়লো। সেই জাহাজে ছিলেন ইথাকার রাজা ওডিসি বা ওডিসিউস। পথভ্রান্ত হয়ে তিনি সাগরের মধ্যে ঘুরে বেড়াতে লাগলেন। জাহাজ কাল এ দ্বীপে গিয়ে লাগে ,কাল ও দ্বীপে। এক এক রকম দ্বীপে এক এক রকম বিপদ দেখা দেয়। বুদ্ধি সাহস কিংবা শক্তি দিয়ে ওডিসিউস সে বিপদ কাটিয়ে ওঠেন। এই ভাবে কেটে যায় কয়েক বছর।
এক দ্বীপে বড় বড় পদ্ম ফোটে ,সেই পদ্মের মধু খেলে মানুষ মাতালের মতো শুধু পড়ে পড়ে  ঘুমায়।জাহাজের লোকজন দ্বীপে নেমে সেই পদ্ম মধু খেয়ে অসাড় হয়ে পড়ে রইলো। বহুকষ্টে ওডিসিউস তাদেরকে আবার জাহাজে নিয়ে তুললেন।
এক দ্বীপে থাকে সাইক্লোপস নামে একচক্ষু -ওয়ালা এক দানব। মানুষ পেলেই সে ধরে নিয়ে গিয়ে বন্দি করে রাখে ,তারপর এক একটিকে ধরে আগুনে ঝলসিয়ে নিয়ে খেয়ে ফেলে। ওডিসিউস  এর দলকেও সে বন্দি করলো। তার চোখ থাকতে তার নজরকে ফাকি দেয়া যাবে না বুঝে ওডিসিউস এক মতলব আঁটলেন। দানব যখন ঘুমোচ্ছিলো তখন একটা জ্বলন্ত ছুঁচোলো লাঠি তার চোখে ঢুকিয়ে দিয়ে তাকে অন্ধ করে দিলেন। দানব কিন্তু তাতেও দমল না,সে গুহার মুখে বসে পাহারা দিতে লাগলো। কিন্তু দানবের ছিল অনেকগুলো  ছাগল, তাদের চরবার জন্য গুহার বাইরে ছেড়ে দেওয়া দরকার। পাছে কেউ ছাগলের পিঠে চেপে পালায় এজন্য দানব পিঠে হাত বুলিয়ে পরীক্ষা করে তাদের ছাড়তে লাগলো। আর ওদিকে ছাগলদের পেটের তলায় ঝুলতে ঝুলতে  ওডিসিউস   দলবল নিয়ে  বেরিয়ে এলেন গুহা থেকে। দানব টের পেলো না যে ছাগল গুলোর পেটের নিচে মানুষ ঝুলছে।
জাহাজে উঠে  ওডিসিউস দানবকে টিটকিরি দিতেই দানব তার আত্মীয় দের নিয়ে ছুটে এলো ,আর তীর থেকে জাহাজ লক্ষ করে বড় বড় পাথর ছুঁড়তে লাগলো। কোনোক্রমে প্রাণ নিয়ে তারা জাহাজ ছেড়ে দিলেন।
মাঝসমুদ্রে রাতের অন্ধকারে মায়াবিনী মৎসকন্যেরা গান গায়। পাগল করা সেই গান শুনলে মানুষের হিতাহিত জ্ঞান থাকে না। মুগ্ধ হয়ে তারা ঝাঁপিয়ে পড়তে চায় জলে পাগলের মতো।ওডিসিউস সঙ্গীদের কান আগে থাকতেই মোম দিয়ে  বন্ধ করে দেন যাতে কেউ না সে গান শুনতে পায়। কিন্তু নিজে তিনি গান শোনার লোভ দমন করতে পারেন না। কিন্তু আত্মরক্ষার জন্য নিজেকে বেধেঁ রাখেন মাস্তুলের সাথে। তবু গান শুনে আত্মহারা হয়ে ছটফট করতে থাকেন তিনি। কিন্তু সঙ্গীরা কেউ বাঁধন খুলে দিতে নারাজ -কারণ সেই রকম নির্দেশ দেওয়া ছিল তাদের কে।  আর কানে মোমের ছিপি  আটকানো থাকায় তারা তো কেউ গান শুনতে পাচ্ছিলো না।
আর এক দ্বীপে থাকে এক জাদুকরী ,তার নাম সার্সি।মানুষ পেলেই সে ভুলিয়ে নিয়ে গিয়ে জাদুর কাঠি ছুঁইয়ে তাদের শুয়োর বানিয়ে রাখে। ওডিসিয়াস এর সাথীদের সে শুয়োর বানিয়ে খোঁয়াড়ে পুরে রাখলো। তারপর ওডিসিয়াস স্বয়ং গিয়ে বুদ্ধির জোরে তাকে জব্দ তো করলেনই ,শেষপর্যন্ত জাদুকরী তার এমন ভক্ত হয়ে পড়লো যে তার সঙ্গীদের  এবং আরো যে সব লোককে সে জানোয়ার বানিয়ে রেখেছিলো তাদের সবাই কে সে তো মুক্তি দিলোই,উপরন্তু  ওডিসিয়াস কে কিছুতেই ছাড়তে রাজি হলো না।ওডিসিয়াস বেশ কিছুকাল তার অতিথি হয়ে কাটিয়ে ফের সমুদ্রে ভাসলেন।সার্সি চোখের জলে তাকে বিদায় জানালো ,সেইসাথে পথে তাদের যাতে কোনো বিপদ না হয় তাই প্রতিকূল বাতাসগুলোকে সে জাদুবলে একটা থলিতে আটকে সঙ্গে দিয়ে দিলো -যাতে সেগুলো কোনো উপদ্রব করতে না পারে। কিন্তু   ওডিসিয়াস এর সঙ্গীদের কারো কারো হলো দূরবুদ্ধি ,কি আছে থলির ভিতরে তা জানার জন্য থলি খুলতেই হু হু করে সমস্ত বাতাস বার  হয়ে এলো আর জাহাজ ফের ঝড়ের মধ্যে হাবুডুবু খেতে খেতে ভেসে চললো বিপথে।
যাই হোক ,এই ভাবে আরো নানান বিপদ আপদ কাটিয়ে ,সঙ্গীদের অনেককে পথে হারিয়ে অবশেষে একদিন ওডিসিয়াস ইথাকায় এসে পৌঁছলেন।
এদিকে প্রায় ২০ বছর ওডিসিয়াস দেশ ছাড়া। এই সুযোগে নানা জায়গা থেকে একদল যুবক (তাদের মধ্যে অনেক রাজপুত্র ও আছে ) এসে জুটেছে রাজবাড়িতে। তারা বলছে রাজা ওডিসিয়াস মারা গেছেন।এখন বিধবা রানী পেনেলোপী তাদের কাউকে বিয়ে করুন ,সেই হবে নতুন রাজা।
রানী পেনেলোপী এর কিন্তু আর বিয়ের ইচ্ছা নেই। তাঁর পুত্র টেলিমেকাস ও বড়ো হয়ে উঠেছে। রানী একখানি কাপড় বুনতে শুরু করলেন। বললেন," এটা হবে আমার বিয়ের পোশাক''।বোনাটা শেষ হলে তিনি স্বয়ম্বর সভা ডাকবেন।
এদিকে দিনের বেলা রানী যেটুকু বোনেন ,রাতে আবার চুপি চুপি তা খুলে ফেলেন। কাপড় বোনা তাঁর আর শেষ হয় না। কিন্তু যুবক দের দলটা আর থাকতে তা পেরে হইচই শুরু করলো।
ওডিসিউস ভিখারির  ছদ্মবেশে রাজধানীতে প্রবেশ করলেন। সমস্ত ব্যাপার শুনলেন ও দেখলেন। তারপর শুরু হলো তাঁর তান্ডব লড়াই ওই বিবাহে ইচ্ছুক যুবক দের সাথে। তাদের মেরে ধরে তাড়িয়ে দিয়ে আবার ইথাকার সিংহাসন এ এসে  বসলেন।তারপর স্ত্রী পুত্র নিয়ে সুখে রাজত্ব করতে লাগলেন।

No comments:

Post a Comment