দক্ষিণ মেরু অভিযান-ক্যাপ্টেন স্কট এর অভিযান
জ্ঞানের সীমাকে বাড়াবার জন্য,অজানাকে জানার জন্য মানুষ যে কি করতে পারে তা ক্যাপ্টেন স্কট এর কাহিনী থেকে পরিষ্কার ভাবে বোঝা যায়।
১৮৬৮ সালের ৫ ই জুন। ইংল্যান্ড এর ডিভনশায়ার এর এক গ্রামে ক্যাপ্টেন স্কট জন্মগ্রহণ করেন। ছেলেবেলা থেকে সমুদ্রের প্রতি তার একটা টান ছিল। সেইজন্য ছেলেবেলা থেকেই তিনি জাহাজের কাজ শিখতে থাকেন এবং কিশোরকালেই জাহাজের কাজে লেগে সমুদ্রযাত্রাও করেন।
এই সময় বিশ্বের নানা দেশ থেকে দক্ষিণ মেরু আবিষ্কারের নানারকম চেষ্টা চলছিল। কোন জাতির লোক আগে গিয়ে সেখানে পৌঁছাতে পারে সেই নিয়ে একটা গোপন স্বপ্ন সব জাতিরই অন্তরে জমা ছিল।
স্কট যখন কামান্ডার হন। সেসময় ইংল্যান্ডে দক্ষিণ মেরু অভিযান এর জন্য একটা দল গড়া হচ্ছিলো। রয়েল জিওগ্রাফিক্যাল সোসাইটি এই অভিযানের আয়োজন করেছিলেন। একদিন স্কট লন্ডনের পথে বেড়াচ্ছেন ,এমন সময় ওই সোসাইটি এর প্রেসিডেন্ট স্যার ক্লেমেন্টস মার্কহ্যাম এর সাথে তাঁর দেখা।স্যার মার্কহ্যামের সাথে পরামর্শ করে স্কট এই অভিযানের অধিনায়কত্ব গ্রহণ করেন।
১৯০১ সালের আগস্ট মাসে "ডিসকভারি"নামক জাহাজে করে স্কট তাঁর দলবল নিয়ে ইংল্যান্ড থেকে দক্ষিণ মেরু এর দিকে যাত্রা করেন।তাঁর সাথে একজন খুব বড়ো নাবিক ছিল,তার নাম আর্নস্ট স্যাকলটন।দক্ষিণ মেরুকে জগতের সকলের কাছ থেকে লুকিয়ে রাখবার জন্য বিধাতাপুরুষ তাঁর চারিদিকে দুর্লঙ্ঘ্য বরফের প্রাচীর গড়ে রেখেছেন এবং তার ওপারে জাহাজ নিয়ে আর মানুষ যেতে পারে না ,মাঝে মাঝে এই বরফের প্রাচীরে ফাঁক দেখা যায়,বরফ যখন গলতে থাকে।
ক্যাপ্টেন স্কট তাঁর দলসুদ্ধ সেই বরফের প্রাচীরের মাঝে এসে উপস্থিত হলেন ,কিন্তু বরফের মধ্যে দিয়ে যাওয়ার কোনো পথ না দেখে ফিরে আসতে বাধ্য হলেন এবং ১৯০২ সালের ফেব্রুয়ারী মাসে কিং এডওয়ার্ড দ্বীপে নোঙর ফেলে রইলেন। তখন দুরন্ত শীত,সমুদ্রের জল জমে বরফ হয়ে গেছে।তাঁরা ঠিক করলেন যে আর কিছুদিন পরে শ্লেজে করে যাত্রা করা যাবে।
মাসকয়েক কাটিয়ে ১৯০২ সালে শ্লেজ যাত্রার সমস্ত আয়োজন হয়ে গেলো। ঠিক হলো যে স্কট,স্যাকলটন ও উইলসনস মাত্র এই ৩ জন যাত্রা করবেন এবং সঙ্গে ১৯ টা কুকুর নেওয়া হবে।
যাত্রা শুরু হলো সেই নির্দিষ্ট দেশের দিকে। কিছুদূর যেতে না যেতে নানা প্রকারের বাধা আসতে লাগলো। ক্রমশ তারা এগোতে লাগলেন। যেখান দিয়ে যান সেখানে এক এক জায়গায় তাঁবু ফেলে খাবার রেখে যান এবং প্রতিটি তাঁবু এর উপর একটা করে পতাকা গুঁজে রাখেন কারণ ফেরার সময় যখন খাবার দরকার হবে তখন এই সমস্ত তাঁবু থেকেই তা পাওয়া যাবে এবং ফেরবার পথের নিশানা হবে।
সমস্ত নভেম্বর ও ডিসেম্বর মাস তাঁরা বরফের মধ্যে দিয়ে ধীরে ধীরে অগ্রসর হলেন।যতই এগোতে লাগলেন বরফের ঝড় তীব্র থেকে তীব্রতর হতে লাগলো। এই অবস্থায় আর বেশিদূর এগোনো যাবে না দেখে স্কট ফিরলেন। ফিরবার পথে বিপদ আরো ঘনিয়ে এলো। স্যাকলটন এর হলো অসুখ।তাছাড়া খাবারের ডিপোগুলো এতো দূরে দূরে পোঁতা হয়েছিল যে এক ডিপো থেকে আর এক ডিপোতে পৌঁছাতে সবাই ক্ষুধায় কাতর ও অজ্ঞান হয়ে পড়তে লাগলো। বিশেষ করে কুকুরগুলো, তারাই শ্লেজ টেনে নিয়ে চলেছে। সেজন্য কুকুরের খাবার জোগাড়ের জন্য তারা একটা কুকুর মেরেই তার মাংস অপর কুকুরগুলোকে খাওয়াতে লাগলেন। এই রকম করে তাঁরা কোনোক্রমে জীবন নিয়ে সে যাত্রায় কিং এডওয়ার্ড দ্বীপে ফিরে এলেন।
কয়েক মাস সেই দ্বীপে কাটিয়ে আবার যাত্রা শুরু করলেন। এবার সঙ্গে মাত্র দুজন সঙ্গী ইভান্স আর লাসলি।এবার তারা চাকাওয়ালা স্লেজে যাত্রা করলেন।,সঙ্গে কুকুর নিলেন না। কিন্তু অনেক দূর যাওয়ার পর খাদ্যের সংস্থান ফুরিয়ে আসতে লাগলো। এবারেও তাঁরা ফিরতে বাধ্য হলেন।
১৯০৩ সালের শেষাশেষি আবার তাঁরা তাঁদের জাহাজে ফিরে এলেন এবং ঠিক করলেন এবারকার মতো ইংল্যান্ড এ ফিরে যেতে হবে। কিন্তু নতুন বিপদ ঘটলো। সামনের সমস্ত পথ বরফে বন্ধ হয়ে গেছে।বারো মাইল পর্যন্ত ঘন বরফ পথ আটকে দাঁড়িয়েছিল। তাঁরা নানারকম যন্ত্র দিয়ে সেই বরফ কেটে পথ তৈরি করতে লাগলেন,কিন্তু কিছুদিন চেষ্টা করে বুঝলেন এ অসাধ্যসাধন।বরাতক্রমে সেবার খুব শিগগিরি বরফ গলতে আরম্ভ করলো এবং কিছুদিন যেতে না যেতেই স্কট দেখলেন বরফ গলে তাঁদের যাওয়ার পথ তৈরি হয়ে গেছে।তাঁরা এ যাত্রায় যতদূর গিয়েছিলেন তার থেকে আরো ৪৬৩ মাইল দূরে ছিল দক্ষিণমেরু।কিন্তু এর আগে কেউই আর দক্ষিণমেরু এর এতো কাছে আসতে পারেন নি।
স্যার আর্নেস্ট স্যাকলটন ১৯০৮ সালে নিজের দল নিয়ে আবার দক্ষিণ মেরু রওয়ানা হলেন,কিন্তু তাঁকেও ফিরে আসতে হলো। তবে এবার আরোও ৯৭ মাইল যেতে পারলেই স্যাকলটন এর ভাগ্যেই দক্ষিণমেরু আবিষ্কারের প্রথম গৌরব লেখা থাকতো।
ক্যাপ্টেন স্কট যখন শুনলেন যে স্যার স্যাকলটন ব্যর্থ হয়ে ফিরে এসেছেন তখন তিনি আর ঘরে বসে থাকতে পারলেন না। ঠিক করলেন যে এবার তিনি যে যাত্রা করবেন ,তাতে হয় দক্ষিণমেরু পৌঁছোবেন,নয় ইংল্যান্ড এ আর ফিরবেন না। এবার স্কট দক্ষিণমেরুতে পৌঁছোলেন বটে ,কিন্তু ইংল্যান্ডে আর তাঁর ফেরা হলো না।
১৯১০ সালের জুন মাসের প্রথম দিকে দলবল নিয়ে স্কট "টেরানোভা'' জাহাজে দক্ষিণমেরুর পথে আবার যাত্রা করলেন। ১৯১১ সালের প্রথম দিকে তিনি আবার সেই দুর্লঙ্ঘ্য বরফের প্রাচীরের কাছে উপস্থিত হলেন।
এখান থেকে দক্ষিণমেরু ৩৫০ মাইল দূরে। এই ৩৫০ মাইল যাওয়া ও ফিরে আসার আয়োজন করতে সেপ্টেম্বর মাস এসে গেল। ১৯১২ সালের নববর্ষের প্রথম দিনে ৮ জন সঙ্গী নিয়ে তিনি দক্ষিণ মেরু এর ১৭০ মাইলের মধ্যে এসে পড়লেন। সেখানে কয়েকদিন বিশ্রাম করে যাত্রার পথে মাত্র ৪ জন সঙ্গীকে নিয়ে রওয়ানা হলেন। সঙ্গে যে যে রসদ নেওয়া হলো তা ডিপোতে ডিপোতে জমা রেখে তাঁরা ক্রমশ দক্ষিনমেরু এর দিকে এগিয়ে চলতে লাগলেন এবং পথে কোনো বিশেষ বিপদের মধ্যে না পড়ে তাঁরা ১৮ জানুয়ারী ১৯১২ সাল,তাদের জীবনের ঈপ্সিত দেশ দক্ষিণ মেরুতে এসে উপস্থিত হলেন। কিন্তু অত্যন্ত দুঃখ এর বিষয় যে ক্যাপ্টেন স্কট সেখানে উপস্থিত হয়ে দেখেন যে ,যেখানে তাঁরা তাঁদের দেশের পতাকা প্রথম পুঁতবেন বলে ভেবেছিলেন ,সেখানে নরওয়ে দেশের পতাকা উড়ছে। তাঁদের কয়েক সপ্তাহ আগে নরওয়ের বিখ্যাত আবিস্কারক আমুন্ডসেন দাক্ষিণমেরুর প্রথম আবিস্কর্তার গৌরব অর্জন করে চলে গেছেন।সেই জনমানবহীন অনন্ত তুষারের দেশে নরওয়ের পতাকা,আর কাষ্ঠফলকে আমুন্ডসেন এর নাম তার বিজয়বার্তা ঘোষণা করছে।
এবার ফেরবার পালা। যাওয়ার সময় তখন কোনো বিপদ হয় নি ,কিন্তু ফেরবার মুখে পথে পথে ভয়াবহ বিপদ এসে বাধা দিতে লাগলো। হাওয়া আর বয় না তার জায়গাতে বয় জমাট বরফের কণা।দিনের পর দিন আকাশ পৃথিবী কিছুই দেখা যায় না,শুধু বরফের বৃষ্টি। সেই ভয়াবহ অবস্থা এর মধ্যে দিয়ে শ্বাসরুদ্ধ অবস্থায় ৫ জন লোক চলেছে।পথের দিশা অনন্ত তুষারপাতের মধ্যে হারিয়ে গেছে। অনাহারে সর্বশরীর অবসন্ন। এই অবস্থায় একদিন ইভানস পড়ে গেলেন ,আর উঠলেন না। সাদা বরফ তাঁর মৃতদেহের উপর কবর রচনা করলো। তুষারপাত প্রতিদিন বেড়ে চলতে লাগলো। অবশেষে তাঁরা একটি ডিপোতে এসে উপস্থিত হলেন। এরপর একরাতে ক্যাপ্টেন ওটস বাইরে গেলেন ,কিন্তু আর ফিরলেন না।
সেই ভয়াবহ অবস্থার মধ্যে দিয়ে অবশিষ্ট দুজন সঙ্গী কে নিয়ে স্কট অগ্রসর হতে লাগলেন। অবশেষে ক্লান্ত দেহে তাদের সঙ্গে যে তাঁবুটি ছিল তাই খাটিয়ে তার ভিতরে ঢুকলেন তাঁরা।তাঁরা ভালোভাবে জানতেন এই তাঁবু ই তাদের কবর। পাশের সঙ্গীর তখন মৃত্যুশ্বাস উপস্থিত। মৃত্যু এর হিমস্পর্শ স্কটের সর্ব অঙ্গ শিথিল করে দিচ্ছিলো। সেই মৃত্যু এর আগে তিনি তার ডাইরীর শেষ পাতা লেখেন -"গত একমাসে আমরা যে কষ্ট পেয়েছি আমি ভাবতে পারি না ,কোনো মানুষ কোনো দিন সেরকম কষ্ট সহ্য করেছে কিনা। তবুও আজ ভাগ্যের বিরুদ্ধে আমার কোনো নালিশ নেই,যা পেয়েছি তা মাথা পেতে গ্রহন করেছি। যদি আমরা বেঁচে থাকতে পারতাম ,তাহলে সমস্ত ইংল্যান্ড শুনতে পেত যে ,ইংল্যান্ড এর গৌরব এর জন্য তার কয়েকজন সন্তান কি কষ্টই না সহ্য করেছে-আমাদের এই মৃতদেহ আর এই লেখা হয়তো জগতে একদিন সে কাহিনী এর সাক্ষ্য দেবে-।
No comments:
Post a Comment