কলকাতার মমি রহস্য
৬ আগস্ট,১৮৩৪ বুধবার।
সন্ধ্যেবেলা কলকাতার এশিয়াটিক সোসাইটি এর পুরোনো বাড়িতে কাউন্সিল এর সভা বসেছে। সোসাইটির সহ সভাপতি রেভারেন্ড এইচ মিল সেদিনের সভাপতি।বোম্বাই (মুম্বাই ) থেকে চিঠি এসেছে ই.সি.আর্চবোল্ড এর।আর্চবোল্ড সাহেব বেঙ্গল লাইট ক্যাভেলরি এর লেফটেন্যান্ট। ৫ জুলাই এর সেই চিঠিতে তিনি লিখলেন :সোসাইটি এর জন্য একটি আকর্ষণীয় উপহার পাঠাচ্ছেন। একটি মিশরী মমি। বেশ কষ্ট করে সেটি তিনি সংগ্রহ করেছেন মিশরের গুরব অঞ্চলের রাজাদের সমাধি থেকে।জাহাজের নাবিকেরা মোকা থেকে মমি সমেত আর্চবোল্ড কে নিয়ে আসছিল।কিন্তু শেষ পর্যন্ত কেন জানি না তারা বেঁকে বসলো। এই ভয়ঙ্কর মৃত শরীরটা আর বয়ে আনতে তারা নারাজ। আর্চবোল্ড সাহেব হালকা রণতরী কূট এর কাছে এক অফিসার কে অনুরোধ করলেন মুম্বাই পর্যন্ত মমিটিকে কোনো মতে পৌঁছে দিতে।
কিন্তু মমি সে যাত্রায় এলো না। সে বছর পয়লা অক্টোবর এশিয়াটিক সোসাইটি তে আর একটা মিটিং বসলো। সেদিন আলোচনার জন্য এলো লেফট্যান্যান্ট আর্চবোল্ড এর একখানা সংযোজনী।যুদ্ধ জাহাজ কূটের সেই অফিসার জানিয়েছেন-না পারা গেলো না। জাহাজের মুসলমান নাবিকদের সংস্কারে আঘাত লেগেছে।মৃত শরীরটা কে তারা জাহাজে তুলে কোথাও নিয়ে যেতে পারবে না। যা অবস্থা তাতে মমিটি মোকা থেকে বাইরে আনার সমস্ত চেষ্টাই কার্যত ব্যর্থ।ওখানেই আবার কবর দিয়ে রাখতে হবে প্রাচীন মিশরবাসীর মৃত শরীরটাকে।
কিন্তু তবুও মমি এসেছিলো কলকাতায় সুদূর মিশর এর গুরব থেকে। সে দেশের বাইরে ইউসুফ নদী র ধারে কায়ুম এর দক্ষিণ সীমান্তে গুরব।প্রাচীন রাজবংশের ও আগের আমল থেকে নতুন রাজবংশ পর্যন্ত কর্মচঞ্চল ছিল গুরব।ফারাও তৃতীয় থুতমোসিস এর প্রাসাদ ,মন্দির ছিল এখানে। আর ছিল তৃতীয় আমেনফিস এর রানী তিয়ের সৌধ ,অট্টালিকা।তুতেনখামেনের বাবা মার্ প্রিয় জায়গা গুরব।ইতিহাস বলে ফারাও দ্বিতীয় রামেসিস এ শহর ধ্বংস করেছিলেন। ভেঙে দিয়েছিলেন তুতেন ,তাঁর বাবা আর আখেনাটন এর মূর্তি।
সে যাই হোক ,মমি একদিন পৌঁছেছিলো কলকাতায়। ঠিক কবে যে এলো তার সন তারিখ ঠিক মতো জানা না গেলেও একথা ঠিক যে ১৮৮২ এর আগেই কলকাতার মাটি ছুঁয়েছিল সে। কেননা ১৮৮৩ তে প্রকাশিত ভারতীয় জাদুঘরের দ্রষ্টব্যের বিবরণীতে তার উল্লেখ রয়েছে সবিস্তারে। মমি এর মানুষটি শুয়ে আছে কাঠের কফিনে। চিত্রবিচিত্র লিনেন এ জড়ানো তার শরীর।মুখের মাংস চামড়া খসে গিয়ে একেবারে হাড্ডিসার। একটা মুখোশ রাখা ঠিক বুকের উপর। একেবারে মুখের আদলে তৈরি। পাশে কফিনের ঢাকা। তাতেও আঁকা মানুষটির পূর্ণ অবয়ব। মমি এর দুপাশে ছোট দুটি কাঁচের বাটিতে গোলাপি রঙের মিহিদানার মতো রাসায়নিক "সিলিকা জেল"।শোকেসে এর বাতাস থেকে আদ্রতা শুষে নেয়।কেস এর মধ্যে ডিহাইড্রেশন এর পরিমান বুঝে নেবার জন্য একটি মিটার।এসব ই মমি কে অপটিমাম কন্ডিশন এ রাখবার চেষ্টায়।কিন্তু যাকে ঠিকঠাক রাখতে এতো চেষ্টা সেই মমি টা কার এ প্রশ্ন সবার সাথে এক কবির মনেও উদয় হয়েছিল।
"মমি" কবিতায় সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত লিখলেন -
পাশ মোড়া দিয়া ঢাকন ঠেলিয়া,
জাগিয়া উঠিল মমি,
মিশরের যত বুড়া জাদুকর
দাঁড়ালো তাহারে নমি'
গুঁড়া হয়ে পড়ে পুঁথি বেশবাস,
গুঁড়া হয়ে ঝরে চর্ম;
যত চাহি তত মনে বাড়ে ত্রাস
তত বহিরায় ঘর্ম!
বাম হাতে তার কবিতার পুঁথি
হরিতালে মোড়া মুখ,
নয়ন কোটরে অতল আঁধার;
দুরু দুরু কাঁপে বুক!
অতি ক্ষীণ স্বরে কহিল সে ধীরে,
সোয়ানরিয়া 'রোমেসেস'-
''নীলনদ তীরে ঘন শরবন,
তীরে সে মিশর দেশ;
আমি সে দেশের রাজার সভায়
ছিলাম প্রধান কবি;
আজি কেহ নাই বুঝিতে সে বাণী
বুঝিতে সে সব ছবি।''
(সংগ্রহ "মমি রহস্য",লেখক শ্যামল কান্তি চক্রবর্তী )
No comments:
Post a Comment