রূপকথা কি ,রূপকথার জনক ও রূপকথার একটি গল্প
রূপকথা বা উপকথা সারা পৃথিবীর সম্পদ। মানুষ যখন ছিল বুনো,অসভ্য,তখন ও সারা দিনের শেষে গুহায় বসে মশালের আলোয় দলপতি শুনিয়েছে গল্প। তার কৌতূহলী শ্রোতাদের চোখের জিজ্ঞাসা কখনো ও ফুরোয় না। তাই আরো ও কত যুগ বাদে সন্ধ্যেবেলা মা ঠাকুমা দিদিমার কাছে শুয়ে শুয়ে গল্প শুনেছে ছেলে মেয়েরা।সাধারণত দেখা যায় এই সব রূপকথার কোনো ও নির্দিষ্ট লেখক নেই। মুখে মুখে ছড়িয়ে গেছে এই সব গল্প কথা।আর দেখা যায় আমাদের সুপরিচিত এক একটি রূপকথার সাথে পৃথিবীর অন্যান্য দেশের রূপকথার আশ্চর্য মিল।
রূপকথা মুখে মুখে তৈরি হলেও কখনো কখনো একজন বিশেষ রচয়িতা তাকে সারা দেশের সম্পদ করে তুলতে পারেন। এই রকমই হান্স ক্রিশ্চিয়ান এন্ডারসন আর ডেনমার্ক এক হয়ে গেছে।ডেনমার্কের ওডেন্স নগরে ১৮০৫ সালে জন্মেছিলেন হান্স ক্রিশ্চিয়ান এন্ডারসন।উপন্যাস,নাটক অনেক লিখেছিলেন তিনি ,কিন্তু তাঁকে অমর করে রাখলো তার রূপকথাগুলি। রাজা রানী ,পশুপাখি ,গাছপালা ,পুতুল -এমনকি সামান্য সূচ নিয়েও তার গল্প। তাঁর বিখ্যাত গল্প ''তুষাররানী'' পড়ে ডিউক আর ওল্ডেনবার্গ তাকে নিজের হাতের হীরের আংটি খুলে দিয়েছিলেন। জার্মানী এর রাজা তাকে উপাধি দিয়েছিলেন যার ইংরেজি হলো 'অর্ডার অব ডি রেড ঈগল', পৃথিবীর নানা ভাষায় এন্ডারসন এর গল্প গুলি অনুবাদ হয়েছে।রূপকথা লেখার জন্য তাকে ''রূপকথার জাদুকর''নাম এ অবিহিত করা হয়। এন্ডারসনের রূপকথা, যার সংখ্যা ৩৩৮১ এর কম নয়, ১২৫ টিরও বেশি ভাষায় অনুবাদ করা হয়েছে। তার সবচেয়ে বিখ্যাত রূপকথাসমূহ হল "দি এমপেরর্স নিউ ক্লদস", "দ্য লিটল মারমেইড", "দ্য নাইটিংগেল", "দ্য স্নো কুইন", "দি অাগলি ডাকলিং", "থাম্বেলিনা",তারই একটি গল্প আজ শোনাবো।
টিনের সেপাই
একজন মিস্ত্রি একটি টিনের পাত কেটে তৈরি করলো ২৫ টি টিনের সেপাই।তাদের গায়ে লাল নীল পোশাক হলো। কাঁধে বন্দুক। সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো সেপাইরা। কিন্তু একটু মুশকিল হলো। সব শেষে টিন কম পড়ে গেলো,তাই মিস্তিরির শেষ পুতুলটিকে করতে হলো খোঁড়া। বাকি ২৪ জনের পাশে এক পায়ে সে রইলো দাঁড়িয়ে। সবগুলো পুতুল একটা বাক্সে ভরে মিস্ত্রি দিলো বাজারে পাঠিয়ে বিক্রির জণ্য।
সেই বাক্স শুদ্ধ কিনে নিলেন একজন লোক একটি ছোট্ট ছেলের জন্মদিন এ উপহার দেবেন বলে।
ছেলেটি তো ভারী খুশি। তার ছিল এক মস্ত টেবিল। সেখানে সে সেপাই গুলোকে সাজিয়ে রাখলো। আরো অনেক খেলনা তার। একটা পিচবোর্ড এর সাজানো গোছানো বাড়ি,বাড়ির সামনে গাছ,পুকুর ,হাঁস।আর বাড়ির ফটকের সামনে রেশমি পোশাক পরা একটি মেয়ে এক পা তুলে নাচছে।হটাৎ মনে হয় তার ও এক পা বুঝি খোঁড়া। খোঁড়া সেপাই তাকে দেখে ভাবলো বেশ তো !মেয়েটিও খোঁড়া ,আমিও খোঁড়া। ওকেই আমি বিয়ে করবো। খোঁড়ার বৌ ও খোঁড়াই হবে। কিন্তু মেয়েটি বড়ো লোক। কি করে ওর সাথে আলাপ করি ?
অনেক রাতে যখন বাড়ির সবাই ঘুমিয়ে পড়ে তখন পুতুলদের জাগার সময়। ওরা তখন নিজেদের মধ্যে কথাবার্তা বলে ,নাচগান করে। আর ঠিক ভোর হবার আগেই চলে যায় যে যার জায়গায়।
একপাওয়ালা সেপাই ভাবছে মেয়ে টি যখন নাচবে তখনি ওর সাথে আলাপ করবে। এই ভেবে যেই সে এগিয়েছে অমনি পেতলের বামুন পুতুলটা তাকে তেড়ে এলো।
খবরদার!ওর সাথে ভাব করবে না।
খোঁড়া সেপাই চুপ করে গেলো।
বড়োলোকের মেয়ে এর সাথে তার আর আলাপ করা হলো না। অন্য পুতুলরা ঘুমিয়ে পড়লো। কিন্তু সেপাই জেগে জেগে পাহারা দিলো সমস্ত রাত।
সকালবেলা খেলতে খেলতে একটি ছেলে সেপাই টিকে বসিয়ে দিলো জানালার ধারে।একটু বাদে এক ঝলক হাওয়া এসে ওকে এক ধাক্কায় ফেলে দিলো একেবারে রাস্তায়। বাড়ির সবাই তাকে কত খুঁজলো,কিন্তু পেলো না।
নিজে সেপাই হয়ে কি করে ই বা চিৎকার করে ডাকে ?তাই খোঁড়া পায়ে কাধে বন্দুক নিয়ে সোজা হয়েই দাঁড়িয়ে রইলো সে। ফুটপাথের পাথরের ফাকে এই ভাবে সে আটকে রইলো।
তারপর নামলো তুমুল বৃষ্টি। বৃষ্টি থামতেই পথের দুধারে জল দাঁড়িয়ে গেলো। পথ দিয়ে যেতে যেতে দুটি ছেলে তাকে দেখতে পেলো। কি আশ্চর্য !একটা টিনের সেপাই !
তারা একটা কাগজের নৌকো তৈরি করে তাতে সেপাই কে বসিয়ে তাকে জলে ভাসিয়ে দিলো। জলের টানে ভেসে চললো নৌকো। একটু পরে সে এসে ঢুকলো নালার ওপর এক খিলানের নিচে। সেখানে দারুন অন্ধকার। কিন্তু সেপাই বন্দুক তুলে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো। একটা ইঁদুর এসে তার পথ আটকাতে চাইলো।সেপাই এর কাছ থেকে কোনো জবাব না পেয়ে ইঁদুরটা কটাস করে কামড়ে দিলো তাকে।
জলের টানে নৌকো আবার এগিয়ে চললো। ড্রেনের কাছে ঘুরে ঘুরে জল চলেছে। এবার নৌকা গেলো ডুবে। নৌকার কাগজ খুলে কোথায় তলিয়ে গেলো। খোঁড়া সেপাই সটান গিয়ে পড়লো নদীর জলে। সেখানে আর এক কান্ড !একটা প্রকান্ড মাছ তাকে গপ করে গিলে ফেললো। মাছের পেটে ভয়ানক অন্ধকার। কিন্তু টিনের সেপাই সেখানেও বন্দুক উঁচিয়ে সোজা দাঁড়িয়ে রইলো।
পরদিন ছেলেরা মাছটি ধরে নিয়ে এলো বাজারে। সেই মাছ কিনে নিয়ে গেলো একটি ছোট ছেলের বাবা। বাড়ির ঝি যেই মাছ টি কেটেছে অমনি তার পেটের ভিতর থেকে বেড়িয়ে এলো একটা খোঁড়া টিনের সেপাই পুতুল।
ছেলেটি দৌড়ে এলো -'ও মা আমার সেই খোঁড়া টিনের সেপাইটা!-সেই যে জানালা দিয়ে পড়ে গিয়ে ছিল।
খোঁড়া সেপাই আবার ফিরে গেলো টেবিলের উপর ২৪ জন সৈনিক এর পাশে।
একদিন শীতকালে ঘরে আগুন জ্বলছিল। ছোট ছেলেটি হটাৎ কি খেয়ালে সেপাই কে ফেলে দিলো আগুনে। নষ্ট হয়ে গেলো তার নীল লাল পোশাক। তবুও সে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো। হটাৎ একটা দমকা হাওয়াই সেই রেশমি পোশাক পরা কাগজের মেয়েটি এসে পড়লো আগুনে -ঠিক খোঁড়া সেপাই তার পাশে।কাগজ পুড়ে ছাই হলো আর টিন গেলো গলে।
বাড়ির ঝি পরদিন এসে সেই কাগজের ছাই আর টিনের টুকরো ফেলে দিলো আবর্জনার মধ্যে।
No comments:
Post a Comment